খুলনায় মুহসিন মহিলা কলেজে উপাধ্যক্ষসহ ৮টি পদে আর্থিক লেনদেন, প্রশ্ন ফাঁস ও অস্বচ্ছতার মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে আর্থিক বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ক্ষুব্দ দীর্ঘদিন ধরে কলেজে মাস্টার রোলে চাকরিরত কর্মচারি ও অন্যান্য পরীক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্টদের কাছে এ নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল এবং অনিয়মের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী সকল পরীক্ষার্থীদের।গত ১৩ জুন মুহসিন মহিলা কলেজে উপাধ্যক্ষ, ল্যাব সহকারি, অফিস সহকারি কাম হিসাব সহকারি, অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার অপারেটর ও অফিস সহায়কসহ মোট আটটি পদের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ নিয়োগে জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি শেখ কামরুজ্জামান ও অধ্যক্ষ মো. আব্দুল লতিফ সু-কৌশলে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে বলে অভিযোগ পরীক্ষার্থীদের। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও সভাপতির কাছে রবিবার (১৫জুন) একাধিক লিখিত অভিযোগের রিসিভ কপি ও কলেজের শ্রেনী কক্ষের কিছু ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে জানা যায় এসব তথ্য।
সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে দেখা যায়, কলেজে অধ্যক্ষের নির্দিষ্ট চেয়ারে তার অনুপস্থিতে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি শেখ কামরুজ্জামান বসে সার্বিক বিষয়ে আলাপ করছেন। কলেজের শ্রেণী কক্ষের বেঞ্চে নির্ধারিত প্রশ্নের উত্তর লেখা রয়েছে। ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে দেখা যায় পরীক্ষা শুরুর আগেই উত্তরগুলো লিখে চর্চা করছিলেন এক প্রার্থী। এছাড়া পরীক্ষায় অংশগ্রহনকারীদের প্রবেশ পত্রে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। যেখানে স্পষ্ট লেখা রয়েছে বিষয়োক্ত পদে নিয়োগের জন্য কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি শেখ কামরুজ্জামানের সভাপতিত্ত্বে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এমন ব্যাতিক্রম প্রবেশ পত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহনকারীরা ইতোপূর্বে কখনো দেখেননি। তাদের অভিযোগ এখানে এই লেখার মাধ্যমে বায়াস করা হয়েছে। যাতে করে যারা অনৈতিক সুবিধায় চাকরী পেতে চায় তারা যেন সভাপতির সাথে যোগাযোগ করেন। আর ঠিক হয়েছে তাই। ল্যাব সহকারি ও অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের জন্য ১০ লাখ টাকা দাবী করেন। যারা টাকা দিয়েছেন তারাই পেয়েছে চাকরি।এ কলেজে মাস্টার রোলে কর্মরত আসমা নামে এক পরীক্ষার্থী বলেন, ওরা বাহির থেকে এসে আজ যে সহায়তা পেয়েছে আমি গত ৬ বছরে এখানের মাস্টাররোলে কাজ করেও পাইনি।
অফিস ল্যাব সহকারী পদে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী হাদীউজ্জামান বলেন, সকাল সাড়ে ৯টায় পরীক্ষা হ্ওয়ার কথা থাকলেও পরীক্ষা শুরু হয় বিকাল সাড়ে ৩টায়। আর পরীক্ষা প্রক্রিয়া চলে রাত ১১ টা পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে আমার কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। আমি বিধি বহির্ভুত না হওয়ায় আমি অপারগতা প্রকাশ করি। যার কারণে আমার পরীক্ষা ভালো হওয়া স্বত্ত্বেও আমার চাকরী হয় নাই। ১৩জুন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও রেজাল্ট মুখে মুখে টেলিফোনে জানিয়ে দেয় কলেজের অধ্যক্ষ। নোটিশ বোর্ডে কোন ফলাফল শীট দেখতে পাইনি।অফিস ল্যাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের পরীক্ষার্থী তানভীর আহমেদ বলেন, আমার রিটেন ও প্রাকটিক্যাল খুব ভালো হয়েছে। সবার আগে আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষা শেষে যখন বাহিরে হাটাহাটি করছিলাম এক ব্যক্তি আমাকে অফার করে ১০লাখ টাকা দিলে চাকরি হবে। আমি রাজি হই নাই। যার দরুন আমার চাকরি হয় নাই।উপাধ্যক্ষ পদের পরীক্ষার্থী মো. শফিকুল আলম বলেন, পরীক্ষায় পক্ষপাতিত্ব ও অনিয়ম করা হয়েছে। উপাধ্যক্ষ পদে কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহফুজার রহমান নিয়োগ লাভের জন্য ১৫ লাখ টাকা প্রদান করেছে। তিনি স্কুলের ইনডেক্স নিয়ে কলেজে চাকরি করছেন। যা বিধি বহির্ভূত। অর্থ প্রদানের কারণে এ প্রার্থীর পক্ষে ফলাফল দেওয়া হয়েছে।কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি শেখ কামরুজ্জামান বলেন, আমি জীবনে কখনো টাকা পয়সার কাছে দূর্বল না। আর আমি কখনো কোন কাজে পার্সেন্টেজ নেই না। তিনি টাকা নেন নাই বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। আর যদি কেউ প্রমান দিতে পারে আমি পদত্যাগ করবো।তবে এই প্রতিবেদক কলেজ থেকে বের হয়ে আসার কয়েক ঘন্টা পর প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করার জোড় অনুরোধ করেন সভাপতি শেখ কামরুজ্জামান। সেই সাথে আর্থিক প্রলোভন দেন।এছাড়া অস্বচ্ছতার কথা স্বীকার করে কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুল লতিফ বলেন, স্বচ্ছতা আর বিধি মোতাবেক এর মাঝে পার্থক্য আছে। সবকিছু বিধি মোতাবেক হয়েছে। এখানে যা কিছু হয়েছে নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়েছে। নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি বলেন, আমি পরীক্ষার হলে একবারের জন্যও যাই নাই। আর এমন কোনো বিষয় নাই যা তার (সভাপতির) অজানা। এসব অনিয়মের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। সবকিছু সভাপতি জানেন। আমি খুব বিপদে আছি।তিনি প্রবেশ পত্রের ব্যাপারে বলেন, আমার ভুল হয়েছে। কিভাবে এমন হলো আমার জানা নেই।জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক মো: আব্দুল হাই সিদ্দিক সরকার বলেন, ফলাফল কলেজ কর্তৃপক্ষ কেনো প্রকাশ করেন নাই এটা তাদের ব্যাপার। আমরা পরীক্ষার দিন রাতেই সব কিছু সম্পন্ন করে দিয়ে আসছি অধ্যক্ষের কাছে। আর আমার চোখে কোন অনিয়ম বাধে নাই। প্রতিটি পদের জন্য ৫জন ব্যাক্তির সমন্বয়ে কমিটি ছিলো। যেখানে অধ্যক্ষ ও সভাপতি ছিলো কমন। তারা প্রতিটি কমিটিতেই ছিলো। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রশ্ন গুলো অধ্যক্ষের রুমে বসে হাতে লিখে প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখান থেকে প্রশ্ন সরাসরি পরীক্ষার রুমে গিয়েছে। সেখানে একজন কম্পিউটার অপারেটর ব্যতীত কমিটির বাহিরে অন্য কেউ উপস্থিত ছিলো না।অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ও নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি ইমরান হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি সবকিছু স্বচ্ছভাবে হয়েছে। প্রশ্নপত্র প্রস্তুত থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত আমি ছিলাম। কোন অনিয়ম আমি দেখি নাই। যারা যোগ্য আমরা তাদের নাম সুপারিশ করে আসছি। তবে বেঞ্চে আগাম উত্তর লেখার ব্যাপারে আমার জানা নাই।
আপনার মতামত লিখুন :